রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শহীদ সেনা সদস্যদের স্বজনরা বলেছেন, ১৫ বছর ধরে আমাদের একটাই দাবি, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। একটা স্বচ্ছ বিচার হোক। বিগত সরকার তদন্ত ও বিচার নিয়ে লুকোচুরি করেছে। আমরা এ বিষয়ে আর লুকোচুরি চাই না। সরকারের পক্ষ থেকে চাপ দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করা হয়েছিল।
বাধার মধ্যে ১৬ বছর পার করেছি। বিডিআরের সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেছেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলুল করিম সেলিম সরাসরি জড়িত পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িত। পৃথিবীর ইতিহাসে একজন সিটিং প্রধানমন্ত্রী একটি বিদেশি রাষ্ট্রের (ভারত) সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে দেশের সেনা অফিসারদের হত্যা করেছেন। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিচারের নামে ১৫ বছরে যা তদন্ত হয়েছে, তা আমরা মানি না। কারণ, পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের যে নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি (শেখ হাসিনা) তখন ছিলেন গণভবনে।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে যে সেনা হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা হয়েছে তা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছে। ওই ঘটনার পর দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কার্যত প্রতিবেশী দেশের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
ওই ঘটনার পর বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে বিজিবি রাখা হয়। কিন্তু পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে গোটা রাষ্ট্র শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিবেশী দেশ ভারতের তাবেদারে পরিণত হয়ে গেছে। সীমান্তে বিজিবি প্রহরা দিয়েছে কার্যত নতজানু হয়ে। সে সুযোগ নিয়ে বিএসএফ বীরদর্পে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার মহোৎসব করেছে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সময়ের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতার আচরণ, কিছু তাবেদার সাংবাদিক ও অনুগত গণমাধ্যমের প্রচারণায় জনমনে রহস্যময়তার জন্ম দেয়। বিদ্রোহী বিডিআরের নেতৃত্ব দেয়া নেতাদের প্রধানমন্ত্রীর বাসা যমুনায় ডেকে এনে আপ্যায়ন করার ঘটনায় প্রথম থেকেই রহস্য ও সন্দেহের সৃষ্টি হয়। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় অবসরে যাওয়া পুলিশ অফিসার কাহার আখন্দকে। কাহার আখন্দ দিল্লির অনুগত ব্যক্তি। তিনি অবসর থেকে ফিরিয়ে এনে ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি চুক্তি ভিক্তিক নিয়োগ দেয়া হয় তাকে। এই কাহার আখন্দ ২০২০ সালের অবসরে যান এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-২ আসনের নৌকার নমিনেশন পান। ওই সময় (বর্তমানে বিতর্কিত) অবসরে যাওয়া সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদকে বিডিআরের মহাপরিচালকের দায়িত্বে বসানো হয়েছিল। আজিজ আহমেদের পরিবারের পরিচিতি সবার জানা।
১৫ বছর আগে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পেছনের রহস্য এখনো দেশের মানুষের অজানা। পিলখানায় শহীদ মেজর জেনারেল মরহুম শাকিল আহমেদের পুত্র সংবাদ সম্মেলনে ‘হত্যাকাণ্ডে ভারত জড়িত’ ইংগিত করে যে অভিযোগ তুলেছেন ঘটনার পরপরই এ ধরনের অভিযোগ এবং আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন দেশের সামরিক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। ওই সময় বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছিলেন এই বলে যে, বড়ইবাড়ি সীমান্তের প্রতিশোধ নিতে ভারত পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি উপজেলার বড়াইবাড়ি সীমান্তে (অন্যদিকে আসাম রাজ্যের সীমান্ত) রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ১৮ জন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী (বিএসএফ) নিহত হয়। সারাবিশ্বে এ নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল।
পিলখানা বিদ্রোহের আগে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা উচ্চ পদস্থ পদগুলো থেকে নিয়মিত সেনা কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারসহ ২২ দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন। পরিবর্তে, তারা চেয়েছিলেন বিডিআর সদস্যদের মধ্য থেকে পদোন্নতি দিয়ে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা করতে হবে। কিন্তু সেটা নিয়ে আলোচনার বদলে চললো তাণ্ডবলীলা। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সময় বিডিআর সদর দফতরের সামনে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক মোতায়েন করা হয়েছিল। অথচ সেনা বাহিনীকে বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দেয়া হয়নি। কেন নির্দেশ দেয়া হয়নি সেটাও রহস্যজনক। প্রশ্ন হচ্ছে ওই সময় কি পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল? রাতের আঁধারে কাদের পিলখানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল সে রহস্য এখনো অজানা।
বিডিআর বিদ্রোহের নামে মহাপরিচালক শাকিল আহমেদসহ কয়েক ডজন বিডিআর সিনিয়র কমান্ডারকে (সেনা সদস্য) প্রথম দিনেই হত্যা করা হয়। অতঃপর ডিআইডি তৌহিদের নেতৃত্বে হত্যাকারীরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যমুনায় যান। এর আয়োজন করে আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক। সেখানে তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। হত্যাযজ্ঞে বিপুল পরিমাণ সেনা অফিসার নিহতের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহীদের জন্য সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব দেন।
গতকাল মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শাকিলের পুত্র রাকিন বলেছেন, রাকিন আহমেদ ভূইয়া বলেন, এক আওয়ামী লীগ নেতা ফোন করে আমাকে বলেছিলেন, ওনার নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমার বাবা-মাকে জবাই দিয়েছেন। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করি তাহলে বাবা-মার মতো আমাকেও জবাই দিয়ে দেবে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই, যেখানে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) অন্য একটা বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে রাজধানীতে ৫৭ সেনা অফিসারকে হত্যা করে। গত ১৫ বছরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারের ট্রায়াল বা তদন্ত আমরা মানি না। কারণ প্রধান যে হত্যাকারী, নির্দেশদাতা তিনি তখন ক্ষমতায় ছিলেন। খুনি কি তার নিজের বিচার করবে? মুখ বন্ধ করে দেখতে হয়েছে, কেমন করে তদন্ত, ট্রায়াল প্রভাবিত করল, ডাল-ভাতের কথা বলল। নীরবতায় সহ্য করতে হয়েছে।
কর্নেল নাহিদের মেয়ে নাবিলা বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডটি আন্তর্জাতিক চক্রের কাজ। আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বারাই কাজটি করা হয়েছে। আপনারা বের করবেন আসল কারণ। এটা বিদ্রোহ নয়, এটা হত্যাকাণ্ড, পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। আমার বাবা মারা যাননি। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিছু অপপ্রচারের জন্য আমরা হেনস্থা হয়েছি। এত দিন ভয়ে কথা বলিনি, আজ নির্ভয়ে কথা বলছি।’ মেজর মোসাদ্দেকের মেয়ে নাজিয়া বলেছেন, ‘আমাদের কষ্টের কথা যদি বলি, একই পরিস্থিতিতে এখনও যাচ্ছি। কষ্ট দূরে হয়ে যায়নি। এর পেছনে অনেক ঘটনা ছিল। আমরা তো আমাদের স্বজনদের হারিয়ে ফেলেছি। মানুষ জানুক, এই হত্যাকাণ্ড কারা করেছে। কেন এত বছর পরও আমাদের মুভমেন্টে বাধা হয়।’
৭ দফা দাবি : এক. পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সত্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে আমরা শহীদ পরিবার মনে করি যে আগে যেসব তদন্ত হয়েছে, সেসব তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। দুই. ন্যায়বিচারের আলোকে আমরা শহীদ পরিবার মনে করি যে হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় মোতাবেক তিন জন জজ যে ইনকোয়ারি কমিশন গঠতের কথা বলেছেন, অবিলম্বে সেই ‘ইনকোয়ারি কমিশন’ গঠন করতে হবে। এতে আমরা মনে করি যে পর্দার আড়ালে রয়ে যাওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের নাম বেরিয়ে আসবে। তিন. অফিসিয়াল গ্যাজেট করে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং গেজেটে শাহাদাতবরণকারী সবাইকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। চার. ২৫ ফেব্রুয়ারি শোক দিবসকে ঘিরে দেশজুড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখতে হবে। পাঁচ. এই নৃশংস বর্বর পিলখানা ট্র্যাজেডিকে স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে কী ছিল এসব শহীদের ত্যাগ। ছয়. এ ঘটনাকে ঘিরে যেসব সেনা কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে অথবা যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এবং সাত. নির্দোষ কোনও বিডিআর জওয়ানকে যেন কোনোভাবেই সাজা না দেয়া হয়।